ইসলামের নবী (সা.)-কে নিয়ে ইউরোপের যে ধারণা, সেটা তৈরি হয়েছে বিগত ১৪০০ বছরের ন্যাক্কারজনক জ্ঞানগত অসততা ও ঘৃণার দ্বারা। এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত বৃটিশ ইতিহাসবিদ Norman Daniel লেখেন:

“নবী মুহাম্মাদের ব্যাপারে একগাদা মিথ্যা তথ্য চালু রয়েছে, যা কেবলই খৃষ্টানদের বিদ্বেষের সমর্থনে কিছু গালগল্প… ইসলামকে আক্রমণ করার জন্য মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমাণের ব্যবহার ছিল ব্যাপকহারে সাধারণ ঘটনা… নবী মুহাম্মাদের এই বিকৃত ইমেজ তৈরি করা হয়েছে যাতে পশ্চিমা জনমনে বিদ্বেষ অনুভূত হয়। [1]

চলুন একনজরে সেই ভয়াবহ মিথ্যার একটা সংক্ষেপিত ফিরিস্তি দেখে নেয়া যাক:

  • সকল খৃষ্টীয় বাতিল ফিরকার সমষ্টিই ইসলাম। খৃষ্টান পাদ্রীরা যেসব আকীদা খণ্ডন করে ত্যাগ করেছে, সেগুলোই একাট্টা করে ইসলাম হয়েছে।
  • আরবরা আসলে মূর্তিপূজক যারা বিকৃত উপাসান করে, খৃষ্টানদের খোদাকে গালাগালি করে এবং ৩ দেবতার পুজো করে (Muhammad, Apollyon and Termagant) [songs chansons de geste (1150–1250)]
  • নবী মুহাম্মাদ (সা.) ধর্মত্যাগী দাজ্জাল (Antichrist) [Peter the Venerable, Pedro Pascual, Ricoldo de Monte Croce, and Ramon Llull]
  • মুহাম্মাদ এবং সেই সাধু মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এক ইহুদি মুহাম্মাদের তরবারি দিয়ে সেই সাধুকে হত্যা করে। মুহাম্মাদ নিজেও বিশ্বাস করে যে সে-ই মাতাল অবস্থায় খুনটা করেছে। এইজন্য সে মদপানকে নিষিদ্ধ করেছে।
  • আরেকটা ভার্সন আছে গল্পটার। মাতাল অবস্থায় একপাল শূকর মুসলমানদের নবীকে খেয়ে ফেলে। আর একারণেই মুসলিমরা মদ -শূকর খায় না। [Mandeville][1]
  • নবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে ডাকা হত ‘Muhammad God’ বা ‘Muhammad our god’ নামে। [Pulci’s Morgante]
  • নবী ছিলেন শারীরিকভাবে খাটো বেখাপ্পা গড়নের। মাথায় ছিল পোড়া ক্ষত, যার কারণে তিনি সর্বদা সাদা পাগড়ি পরতেন। যা এখন পরে তার অনুসারীরা। [George Sandy]
  • নবীজীর নাম বিকৃত করে কখনও 'Mohmet', 'Mahmet', বা 'Mahoo' লেখা হত (As in Shakespeare's King Lear). আর এই বিকৃত শব্দগুলো শতাব্দীকাল ধরে ‘প্রতারক’ এর সমার্থক হিসেবে ইউরোপীয় ভাষাগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে।
  • তাঁর নামকে বিকৃত করে রাখা হয়েছে (from Muhammad to Mahound), যার অর্থ পরিগ্রহ করেছে ‘সাক্ষাৎ শয়তান’ (devil incarnate)

চলুন দেখি, নবীজীকে নিয়ে লেখা বইগুলোর নামের কী ছিরি! মধ্যযুগে ইউরোপে ইসলাম ও নবীজী (সা.)-কে পরিচিত করেছিল এই বইগুলোই।

  • John of Damascus লিখেছিল (d. 750 AD) De Haeresibus (ইসমাঈলীয়দের বিকৃত মতবাদ)
  • Robert of Ketton কুরআনের অনুবাদ করেছিল (in Latin, 1143), নাম দিয়েছিল Lex Mahumet pseudoprophete (ভণ্ডনবী মুহাম্মাদের আইন).
  • John Lydgate-এর ‘পতিত রাজপুত্র’ (c.1440),
  • William Bedwell-এর ‘প্রতারক মুহাম্মাদ’ (1615),
  • Isaac Barrow-এর ‘মূর্তিপূজা ও মুহাম্মাদবাদের অধার্মিকতা ও প্রতারণা’ (1675),
  • Humphrey Prideaux-এর ‘মাহোমেটের জীবনে এক ডাহা প্রতারকের চিত্র’ (1697)
  • James Miller-এর ‘প্রতারক মাহোমেট’ (1764),
  • William Bedwell-এর (1615) ‘Mohammedis imposturae’ (প্রতারক মুহাম্মাদ)। বইয়ের ট্যাগলাইন: ধর্মদ্রোহী কামুক মুহাম্মাদের বহুমুখী জালিয়াতি, মিথ্যা এবং ভয়াবহ পাপের উন্মোচন।

দেখুন, শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের শিক্ষিত সমাজের ইসলামের ব্যাপারে, ইসলামের নবীর ব্যাপারে যে চিন্তা-চেতনা, তা নির্মাণ করেছিল কিন্তু এই বইগুলোই। যা সত্য থেকে বহুদূরে তো বটেই, বরং মিথ্যারও ঊর্ধ্বে চলে গেছে। মুসলিমদের ব্যাপারে ইউরোপের ধ্যান-ধারণার উপর একজন বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিক John Tolan এসব মধ্যযুগীয় রচনার ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সযত্নে নির্মিত’ (carefully constructed) প্রবণতাকে বলেছেন:

“এসব লেখকেরা অদক্ষ এলোমেলো খিচুড়ি খাওয়াননি; বরং সুচতুর এবং সুনির্মিত তর্ক তৈরি করেছেন, যদিও সেসব মিথ্যা।  [83, কারেন]

এই সেদিন ১৮ শতকে এসে এই প্রবণতা বদলেছে ইউরোপের, যখন ইউরোপেরই অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন ডাচ ধর্মতত্ত্ববিদ Adriaan Reland (died 1718)-এর মতো মানুষরা মুহাম্মাদ সা.-এর আরও নিরপেক্ষ মূল্যায়নের কথা বলতে শুরু করেছেন। মধ্যযুগ-পরবর্তী জীবনীকাররা সরাসরি বিদ্বেষ না উগড়ে ছদ্মাবরণে ঘৃণা ছড়ানোর চতুর কৌশলটা গ্রহণ করে। নবীজীবনের নানান তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে তারা সেই আগের অবস্থানই প্রমাণ করে ছাড়ল। আর এটা করতে গিয়ে তারা আগের অপবাদগুলোকেই একটু মধু মাখিয়ে বলল, অধিক শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণকে দেখেও না দেখার ভান করল, আর ঘৃণার সাথে দু’চামচ প্রশংসা মিশিয়ে নিল।

তাই, আমরা যদি তাকে আদৌ বুঝে থাকি, যদি আমাদের অতীতের টেনে আনা ভুল সংশোধন করতে চাই, তবে আমাদের অবশ্যই মুহাম্মাদ-এর নিশ্চিত সততা ও লক্ষ্যের অবিচলতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। [Watt]

অতএব, তারা তাদের ঘৃণা প্রচার ও অপবাদের পদ্ধতিকে সংশোধন করল। সেসব ত্যাগ করল না, বরং ‘সংশোধন’ করে নিল। চলুন দেখি কীভাবে:

  • Sprenger নবীজীর শারীরিক গড়ন, অভ্যাস ইত্যাদির বর্ণনা দিচ্ছেন, তিনি নাকি ছিলেন বিষণ্ণ ও সর্বোচ্চ মাত্রায় স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগা একজন (melancholic, and in the highest degree nervous) মানুষ। (89) কখনও স্প্রেঙ্গার সাহেব নবিজির মাঝে কিছু ভালো গুণ পেয়ে গেলেও তার ক্রেডিট অন্য কাউকে দিয়েছেন যেমন, বিরোধিতার মুখে নবিজির অসাধারণ দৃঢ়তা ও অধ্যবসায় নাকি আসলে তাঁর স্ত্রী খাদীজা রা.-এর সহনশীলতার কারণে। ইত্যাদি।
  • উইলিয়াম ম্যুর তাঁর গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে নবিজির চরিত্র বিশ্লেষণে গিয়ে প্রতিটি পজিটিভ বৈশিষ্ট্যের পরে নেগেটিভ কিছু না কিছু দিয়ে শেষ করেছেন। ফলে পাঠকের মনে হয় যে এই মূল্যায়ন সুচিন্তিত ও ভারসাম্যপূর্ণ অথচ মনে তৈরি করে যায় একটা নেগেটিভ ছাপ।[1]
  • স্ট্যানলি লেনপুল লিখছেন: “আমরা জানি, মুহাম্মাদের নির্দেশনা নিখুঁত ছিল না আর তাঁর মাঝে অনেক দোষও ছিল; কিন্তু তাঁর ব্যাপারে আমরা যা-ই মনে করি না কেন, আমাদের মেনে নেয়া উচিত তাঁর এসব ভুলগুলো পরিকল্পিত স্বার্থতাড়িত ছিল না। বরং এসব ছিল একজন অজ্ঞ, অনুভূতিপ্রবণ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অথচ অভিজাত মহান একজন মানুষের স্বাভাবিক ভুল” ।[2]

অন্যান্য মধ্যযুগ-পরবর্তী জীবনীগুলোতেও নবিজীর ব্যক্তিত্বের উপর সেই একই বিদ্বেষপূর্ণ পরিকল্পিত আক্রমণেরই প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছু ছিল না:

  • George Sale's The Koran, commonly called the Alcoran of Mohammed: (1734),
  • Simon Ockley's The History of the Saracens: Lives of Mohammed and His Successors,
  • Samuel Bush’s Life of Mahomet (1830),
  • David Price’s Chronological Retrospect of Mahommedan History (1811-1821),
  • Charles Mills’ History of Mahommadanism (1820),
  • William Cooke Tylor’s History of Mohammetanism and its Sects (1834),
  • Bosworth Smith's Mohammad and Mohammadanism (1874),
  • Sir William Muir's The Life of Mahomet (1859),
  • Washington Irving's Mahomet and His
    Successors (1850),
  • Gustav Weil Muhammad the Prophet, His Life and His Book (1843)
  • Aloys Sprenger’s The Life of Mohammad from Original Sources (1851).
  • Richard Southern’s Western Views of Islam in the Middle Ages (1962).

জ্ঞানগত অসততা আর অকারণ অপ্রমাণিত ঘৃণাচর্চা চলতেই থাকল ইউরোপে, আরেকটু মার্জিতভাবে, মিষ্টিমধুর ছদ্মাবরণে। যেমন বৃটিশ ওরিয়েন্টালিস্ট জর্জ সেল তার কুরআনের অনুবাদে (১৭৩৪) কুরআনকে বলছে ‘স্পষ্ট জালিয়াতি’ আর নবিজীর দাওয়াতকে বলছে ধোঁকাবাজি ও ক্ষমতার লোভ অর্থাৎ ‘নিজেকে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় নিতে চাওয়ার পরিকল্পনা’। মুহাম্মাদ সা. সচেতনভাবেই ক্ষমতারোহণের জন্য ইসলাম নামক প্রতারণা সাজিয়েছেন, এটা বহুদিন ইউরোপে মেইনস্ট্রীম চিন্তা ছিল। এই প্রবল মতকে প্রথম জোরালোভাবে চ্যালেঞ্জ করেন Thomas Carlyle তাঁর “On Heroes, Hero-Worship, and the Heroic in History” বইতে (1841):

বর্তমানে এই সময়ে অন্য যেকোনো বাণীর চেয়ে মুহাম্মাদের বাণীতে ঈশ্বরের বেশিরভাগ সৃষ্টি বিশ্বাস করে। ফলে, মুহাম্মাদের দাওয়াহ-কে কেবল ‘শোচনীয় আধ্যাত্মিক ভেলকিবাজি’ বলে উড়িয়ে দিলে ঠিক হবে না। এই ব্যক্তিকে ঘিরে যে সোৎসাহ মিথ্যাচারের পসরা সাজানো হয়েছে, তা কেবল পশ্চিমেরই অপমানের কারণ’। (Carlyle, 895)   

তাহলে এখন কী করতে হবে? পরের ধাপ হচ্ছে, এটা মেনে নেয়া যে নবিজি নিজেকে নবি ভাবতেন আন্তরিকভাবেই, নিজের নবুওয়াতের ব্যাপারে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহ। এই বিভ্রমই তাঁকে দাওয়াতী কাজে নিষ্ঠার সাথে লাগিয়ে রেখেছিল। প্রতারণামূলকভাবে ক্ষমতারোহণের পরিকল্পনায় করেননি, বিভ্রান্ত হয়ে আন্তরিকভাবেই করেছিলেন (delusion of prophethood)।

এভাবেই চলতে থাকল একগাদা ভালোর মাঝে সামান্য অথচ গভীর মন্দের মিশেল। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, নবীজীর নামে মরিয়া হয়ে ইউরোপের শিক্ষিত সমাজের এই মিথ্যাচারের পেছনে কারণগুলো কী কী? চলুন দেখা যাক তাদের জবানিতেই:

১.

একে একে ১১টা ক্রুসেডে পরাজয়ের স্মৃতি, ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে মুসলিমদের পরাভূত করার আশা জিইয়ে রাখা… ইসলামী আকীদাগুলো শত্রুর ধর্ম এবং একে সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখা। [Hitti, 48-49]

মধ্যযুগে খ্রিস্টানরা হযরত মুহাম্মদকে ভুল বুঝেছিল। এ কারণে তার বিরুদ্ধে অশুভ ধারণা রাখত। … ইতিহাসের দৃষ্টিতে এর পিছনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণই ছিল অন্যতম [Islam : a way of life : Hitti, Philip K]

‘যরথুস্ত্রবাদ, বুদ্ধধর্ম এবং অন্যান্য কম পরিণত ধর্মগুলো কখনোই ইউরোপে এতো গালাগালি আর নিন্দামন্দের শিকার হয়নি। মূলত ভয়, শত্রুতা এবং কুসংস্কারই ইসলামের ব্যাপারে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলিমদের প্রতি তাদের আচরণ গড়ে তুলেছিল’। [Hitti]

২.

‘নিশ্চয়ই শিক্ষত ও জনপ্রিয় লেখকেরা আরবদেরকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরেছিল যাতে ক্রুসেডগুলোকে জনতার চোখে যথার্থ করে তোলা যায় আর নিজেদের ধর্মীয় উৎসাহ প্রকাশ করা যায়’। (Jones, 202–203)[1]

৩.

‘ক্রুসেডে খ্রিস্টানদের ঐতিহাসিক পরাজয় তিক্ত স্মৃতি হয়ে তাদের পোড়াচ্ছিল। পরবর্তীতে তুর্কী অটোমানদের সাথে চলমান বৈরিতা খ্রিস্টজগতকে করে দেয় বিষময়। ফলে ইসলাম ও তার নবির বিরুদ্ধে মিথ্যাচার চলতেই থাকে’। [The call of the minaret : Kenneth Cragg]

পশ্চিমা দেশগুলোতে ইতিহাসের পাতায় হযরত মুহাম্মদকে (সা.) যত ঘৃণিত ও হেয় প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে, বিশ্ব ইতিহাসে অন্য কোন মহামানবের বেলায় এমন করা হয়নি। [MUHAMMAD AT MECCA, William Montgomery Watt) এভাবেই পশ্চিমের কলমে মুহাম্মাদ সা. এর ইমেজ আগে ছিল বিপথগামী ধর্মত্যাগী, এখন হল আন্তরিক কিন্তু বিভ্রান্ত উদ্যমী মানুষ। এই ছাঁচেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে মুহাম্মাদ সা. এবং মানুষের ধর্মীয় অভিজ্ঞতা হিসেবে কুরআন হয়ে দাঁড়াল পশ্চিমাদের নতুন এক একাডেমিক আগ্রহের জায়গা। বিপুল পরিমাণে জার্মান ইহুদী ও বৃটিশ প্রোটেস্ট্যান্টরা এক্কেবারে প্রাচীন মুসলিম টেক্সট থেকে তথ্য আহরণ করে নবিজীবন নিয়ে নানামুখী আলোচনা সাজালেন বিংশ শতকে।


[1] Norman Daniel, Islam and the West, p264-267

[2] Reeves, Minou. Muhammad in Europe: A Thousand Years of Western Myth-Making (Washington Square, New  York: New York University Press, 2000).

[3] Muir, Life of Mahomet, 2nd ed., 320, 321.

[4] LanePoole, Speeches and Table- Talk, lV.

[5] Jones,C. Meredith "The Conventional Saracen of the Songs of Geste," Speculum 17 (1942): 201—25.