উপনিবেশ আমলে আমাদের দেশের শিল্পখাতকে ধ্বংস করে দেয়া হয় সিস্টেমেটিক্যালি। আইন করে করে। বৃটিশ পর্যটক ফ্রান্সিস বুকানন দেখাচ্ছেন (আওরঙ্গজেবের আমলে সম্ভবত) বাংলা অঞ্চলের যে পরিমাণ মানুষ কৃষিজীবী সমপরিমাণ মানুষ শিল্পজীবী। প্রোটো-ইন্ডাস্ট্রিয়াল এই অবস্থা ধ্বংস হয়েছে বৃটিশের হাতে। বৃটেনের ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের জন্য ভারতের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করা জরুরি ছিল। এবং ভারতকে কৃষিপ্রধান ও কাঁচামাল সাপ্লায়ার দেশে পরিণত করা দরকার ছিল। একই কাজ মিশরেও করা হয়, উসমানি সাম্রাজ্যকেও করা হয়।
পুরো সাবেকী উপনিবেশ প্রজেক্টের লক্ষ্যই ছিল স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল নিয়ে মেট্রোপলিসে (মাদার কান্ট্রির) শিল্পায়ন করা। সেই প্রডাক্ট এনে আবার উপনিবেশে বেচে প্রচুর মুনাফা করা। ও পুঁজিবাদের বিকাশ করা। এটাই ইউরোপের আজকের ধনী হবার ইতিহাস। স্বল্পমূল্যে কাঁচামাল, স্বল্পমূল্যে শ্রম, বেশি মূল্যে বিক্রি, বেশি মুনাফা। এই কয়টা সমন্বয় করে মুনাফা বাড়ানো হয়।
এখন বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেশি, ফলে শ্রমের মূল্য কম। এটাই তৈরিপোশাক সেক্টরে বাংলাদেশের উন্নতির মূলমন্ত্র। শিল্পায়ন যে নৈতিক সমস্যাটা তৈরি করে সেটা হল: পণ্য বানিয়ে ফেলে সবকিছুকে, অবজেক্ট বানিয়ে ফেলে। যেমন: তসলিমা বলছিল একদিন সে চিকেন খাচ্ছে, এটা প্রাণিহত্যা না, এটা লাইভস্টক। খাওয়ার জন্যই ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে প্রডাকশন করা খাবার। তার মানে কৃষকের পালা গরুটা গরু, কিন্তু বিশাল বিশাল র্যাঞ্চে হাজার হাজার গরু পালাটা লাইভস্টক, সেখানে নৈতিকতা উপচে ওঠে না। তো, একইরকমভাবে শ্রমিকরা এই সেটআপে মানুষ ঠিক না, বরং মেশিন।
যদি গার্মেন্টস সেক্টরে জব করে, এমন আত্মীয় থাকে আপনার, ভিতরের খবর নিতে পারেন। সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়া আপনাকে শুধু দেখাবে জাতীয় অর্থনীতিতে কী বিপুল অবদান, নারীর ক্ষমতায়নে, কর্মসংস্থানে এত এত ডিজিটের উন্নয়ন হচ্ছে। ভিতরের সত্যটা হল, মানুষের মূল্য মেশিন হিসেবে, কত প্রডাকশন সে দিতে পারছে। নইলে মানুষ 'বেকার', শিক্ষিত হয়েও নারী বেকার। শিল্পায়িত দুনিয়ায় তার থেকে প্রডাকশন নেই। গার্মেন্টস শিল্পে এসব শ্রমিকরা কেবল মেশিন। মিনিটপ্রতি কত প্রডাকশন, তা হিসেব করে দৈনিক যে টার্গেট দেয়া হয়, তা করতে গেলে টয়লেট করার সময়ও থাকে না। বেতন যা দিবে, তাতে অসুস্থ হলে চিকিৎসা তো দূরে থাক ডেইলি প্রোটিন-ভিটামিনের চাহিদাও ঠিকমতো হবে না। জাস্ট প্রাণটা থাকবে, আর কাজ করতে পারবে।
হিউম্যান ডিগনিটি তো আর মেশিনের থাকবে না। গালাগাল করতে না পারাটা সুপারভাইজারের অযোগ্যতা এখানে। হাউসনিগার যেমন শ্রমিক নিগ্রোদের চাবুকপেটা করে প্রডাকশন ঠিক রাখতো, এখানে কথার চাবুক ব্যবহার করা হয়। নইলে কাজে ফাঁকি দেয়। এটা করতেই হয় এখানে। গার্মেন্টস, চা, তামাক… এসব সাপ্লাই চেইনগুলো অবিকল সেই উপনিবেশ, সেই দাসপ্রথার একটু আধুনিক রূপ। তখন মালিক খাওয়াত, এখন ঐ খাওয়ার খরচটুকুই দেয়, নাম দিয়েছে বেতন। মিথ্যা স্বাধীনতার অনুভূতি দিয়ে সেই উপনিবেশেরই ধারাবাহিকতা। আগে তো দাস মরলে মালিকের অর্থনৈতিক একটা লস হত। এখন তাও আর হয় না। শ্রম দেবার অঢেল লোক আছে। মরলে মরুক।
দারিদ্র্য-কে ইচ্ছাকৃতভাবে জিইয়ে রাখে এই সিস্টেম, যাতে কমমূল্যে শ্রমের এই যোগান ঠিক থাকে। বিদেশী বায়ার, দেশি শিল্পপতি, উপনিবেশের দালাল শাসকরা মিলে প্রভুদের এই স্বার্থ টিকিয়ে রাখে। ইসলাম, যাকাতের বিধান, পরিবারব্যবস্থা, সুদমুক্ত অর্থনীতিকে এরা শত্রু জ্ঞান করে।
শ্রমিকের শ্রমের প্রকৃত মূল্য দিতে পারে একমাত্র ইসলাম। শ্রমিককে মালিকের সাথে বারগেইনিংয়ের ক্ষমতা দিতে পারে ইসলাম। মালিকের লাভে শ্রমিকের অংশ নিশ্চিত করতে পারে কেবল ইসলাম। বিদেশীদের স্বার্থরক্ষা থেকে বেরিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা, প্রকৃত মুক্তি, প্রকৃত দারিদ্র্য বিমোচনের ফর্মুলা আছে ইসলামে, শরীয়াতে। ইসলামপন্থীরাই স্বাধীনতার প্রকৃত সিপাহী, বাকি সবাই নত হয়, বাঁকে, বশ্যতা মেনে নেয়।
কয়েকটা সংখ্যা থেকে মানুষের মর্যাদায় তুলতে পারে ইসলাম। মানুষকে মানুষের জীবন দিতে পারে শরীয়াহ ব্যবস্থাপনা। আর কিছু না।