ধর্ষণ কী? অপরাধের সংজ্ঞা ধোঁয়াশাপূর্ণ হতে পারে না। অপরাধের সংজ্ঞা অস্পষ্ট হতে পারে না। অপরাধের সংজ্ঞা যদি হয় অস্পষ্ট, তাহলে অপরাধী ফসকে যাবে, নিরপরাধ ফেঁসে যাবে।
আধুনিক সংজ্ঞা
‘সম্মতি’ নিয়ে স্বেছাচারিতার আরেক নজির হলো ধর্ষণের সংজ্ঞায়নে সম্মতির ধারণা। মিলনে সম্মতি না থাকলেই ধর্ষণ, ঠিক আছে। কিন্তু সম্মতি যে নেই, এর প্রমাণ কী? সুইডেনের মতো কিছু অত্যাধুনিক দেশে ২০১৮ সালের নতুন আইনে বলা হয়েছে:
জোর করুক বা না করুক, হুমকি দিক বা না দিক, মনে মনে সম্মতি নেই, এমন সহবাস মানেই ধর্ষণ। ভিকটিমের পক্ষ থেকে শারীরিক প্রতিরোধ থাকা জরুরি না, এমনকি মুখে ‘না’ বলাও জরুরি না। (sex without consent is rape, even when there are no threats or force involved.)
Press release from Ministry of Justice (26 April 2018). Consent – the basic requirement of new sexual offence legislation. Government Offices of Sweden.
Sweden approves new law recognising sex without consent as rape, BBC [24 May 2018]
জোর করতে হয়নি, নারীর পক্ষ থেকে শারীরিক কোনো প্রতিরোধও নেই। এরপরও একে ধর্ষণ বলা হচ্ছে, কেননা মনে মনে তার সায় নেই। বা যদি ঘটনার ৬ মাস পর মেয়েটি বলে আমার মনে মনে সায় ছিল না, প্রতিরোধ করিনি তো কি হয়েছে। তা প্রমাণও করার প্রয়োজন নেই। নারী প্রমাণের দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে?
একটা কেইস স্টাডি শোনেন। সুইডেনে এক লোকের ৮ মাসের জেল হয়েছে। তার অপরাধ হলো:
- সে আর ভিকটিম একই বিছানায় শুয়েছে। ভিকটিম বলে দিয়েছে: সে সেক্সে আগ্রহী নয়।
- একই বিছানায় শোবার সময় ভিকটিম কেবল অন্তর্বাস পরিহিতা ছিল।
- লোকটি এক পর্যায়ে সেক্স ইনিশিয়েট করে (ফোরপ্লে)
- এসময় ভিকটিম নীরব ছিল, কোনো কথা বলেনি, প্রতিরোধও করেনি। কোর্টে সে জানিয়েছে, আমি নিথর-বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম।
- আসামী বলছে, আমি আসলে ভেবেছি ঘুমন্ত বলে সাড়া দিচ্ছে না। পরে মনে হয়েছে ভিকটিমের শারীরিক সায় আছে।
- এক পর্যায়ে আসামী বুঝতে পারে ভিকটিমের সায় নেই, সে সেক্স বন্ধ করে দেয়।
এই নতুন অপরাধের নাম Negligent Rape, এর দায়ে আসামীর ৮ মাস জেল ও অন্যান্য অপরাধ মিলেঝিলে ২ বছর ৩ মাস জেল হয়েছে।
সুইডিশ ইংরেজি পত্রিকা The Local জানাচ্ছে, নারীবাদী-মানবাধিকার এক্টিভিস্টরা এই আইনে খুব খুশি হলেও, Sweden‘s Council on Legislation জানিয়েছে: আইনটি খুবই ধোঁয়াশাপূর্ণ।
Catherine Edwards (12 July 2019), ‘Negligent rape‘: Has Sweden‘s sexual consent law led to change? The Local
মানে নারী যদি বলে আমার সায় ছিল না, তাহলেই বয়ফ্রেন্ড শ্যাষ, নারীর অপ্রামাণ্য স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ রয়েছে এই ‘সম্মতি’র মারপ্যাঁচে। Yale University-র প্রফেসর Joseph J Fischel এবং কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক Heidi Matthews-এর মন্তব্য দুটো আছে এখানে। এই ঘটনাটুকু আর্টিকেল শেষ হলে আবার পড়ার অনুরোধ রইল। এবার আমরা দেখব, ধর্ষণের আগের সংজ্ঞা কী ছিল, ইনফ্যাক্ট বাংলাদেশ পেনাল কোডে এখনও এটাই আছে।
ধর্ষণের আগের সংজ্ঞা
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি- ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞা দেওয়া আছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর-সহ আরও বহু দেশ যারা ব্রিটিশপ্রণীত এই ‘দণ্ডবিধি-১৮৬০’ আত্মীকরণ করে নিয়েছে, সে সব দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা এটাই। সংজ্ঞাটা বুঝে নিতে হবে। কেননা আমাদের পরবর্তী বিভিন্ন আলোচনায় এটা কাজে আসবে।
কোনো পুরুষ (A man) ‘ধর্ষণ’ করেছে বলা হবে, যদি নিচের ৫টা শর্তের যে-কোনো ১টায় পড়ে, যদি সে এমনভাবে কোনো নারীর (a woman) সাথে যৌনসঙ্গম করে (sexual intercourse) :
- প্রথমত, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে (Against her will)
- দ্বিতীয়ত, তার সম্মতি ছাড়া (Without her consent)
- তৃতীয়ত, সম্মতি আছে। কিন্তু সম্মতি নেওয়া হয়েছে মৃত্যুভয় দেখিয়ে বা আহত করার হুমকির মুখে।
- চতুর্থত, সম্মতি আছে। কিন্তু মহিলা তাকে নিজ বৈধ স্বামী মনে করে ভুলে সম্মতি দিয়েছে। আর লোকটা কিন্তু ঠিকই জানে যে, সে তার স্বামী না।
- পঞ্চমত, ১৪ বছরের নিচের নারী, তার সম্মতি থাকুক আর না-ই থাকুক।
ব্যাখ্যা : লিঙ্গ প্রবেশ করানোই (Penetration) ধর্ষণ প্রমাণে যথেষ্ট।
ব্যতিক্রম : স্ত্রী যদি ১৩ বছরের নিচে না হয়, তবে স্বামী কর্তৃক যৌনসঙ্গম ধর্ষণ নয়।
প্রথম ২টি শর্ত লক্ষ্য করুন। সামনে আমাদের লাগবে।
প্রথমত, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে (Against her will)
দ্বিতীয়ত, তার সম্মতি ছাড়া (Without her consent)
আইনের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে: ইচ্ছে হলো আকাঙ্ক্ষা। আর সম্মতি হলো আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ (মৌখিক বা অমৌখিক)। মানে আমার যে সম্মতি নেই, এর একটা প্রকাশ থাকতে হবে, সেটা হতে পারে মৌখিক, হতে পারে প্রতিরোধ। একটা প্রকাশ না থাকলে, শুধু মনে মনে ইচ্ছা না থাকলে তাকে 'সম্মতি না থাকা' বলে না। নিচের চার্টটা খুব ভালোভাবে দেখুন। ইচ্ছা এবং সম্মতি আছে, নাকি নেই, তার ভিত্তিতে কয়েকটা সিনারিও আসতে পারে।
৫ নং কেস নিশ্চিত ধর্ষণ, নো ডাউট। কিন্তু ৪ নং কেস কি ধর্ষণ? ৪ নং ধর্ষণ কিনা, এটা কীভাবে নির্ধারণ হবে? নারীর মুখের কথায়? কীভাবে প্রমাণ হবে যে তার সম্মতি আসলেই ছিল না?
এখানে ইসলামের সংজ্ঞায়ন খুব ক্লিয়ার-কাট। ৪ নং ক্ষেত্রে ধর্ষণ হবে তখনই, যদি প্রতিরোধ না করার কারণ হয় ভীতি-প্রদর্শন। ভীতি-প্রদর্শনের দরুন নারী যদি প্রতিরোধ না করে, তবে নারী অপরাধী না। কোনো ভয়ভীতি নেই, কিচ্ছু নেই, এরপরও নারী প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি মানে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। সম্মতির নামে নারীকে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ করে দেওয়া কোনো যৌক্তিক আইনের ভিত্তি হতে পারে না (সুইডেনের ঘটনাটা)।
বাস্তবে, ধর্ষণ (৫ নং ক্ষেত্রটা) অনেকগুলো অপরাধের সমষ্টি। ধর্ষিতার মেডিকেল পরীক্ষায় সেটা স্পষ্ট বুঝা যায়। জোর করে সঙ্গম, বাধার দরুণ শারীরিক প্রহার, চড়-থাপ্পড়-জখম, বাধা দেবার চেষ্টার (ক্রস লেগ) বিপরীতে প্রচণ্ড আঘাত করা, যোনিপথ জখম, দংশন— এই অপরাধ কয়টির সম্মিলিত রূপ হলো ধর্ষণ।
নিজ স্বামীর প্রতি স্ত্রীর বাধা থাকবে দুর্বল-সাময়িক; ফলে সহবাসে অসম্মতি থাকতে পারে, তবে প্রতিরক্ষা থাকবে না (৪ নং)। ফলে ধর্ষণের পাশবিকতা বা ভায়োলেন্স এখানে অনুপস্থিত। অসম্মতিতে সহবাস (৪) আর ধর্ষণ (৫) বাস্তবে এক জিনিস না, বাস্তবতা এক না। এক্টিভিস্টদের জোরাজুরিতে একটা ধোঁয়াশাপূর্ণ আইন করে দিলেই বাস্তবতা বদলে যায় না।
নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাসটা অসম্মতিতেও হতে পারে, কেননা ইসলামে ‘নিকাহ’ ধারণায় ‘সঙ্গম’-ই কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য। একজন স্বাধীন নারীর যৌনাঙ্গ একজন পুরুষের জন্য বৈধ হবার আইনী ভিত্তি— নিকাহ। পশ্চিমা সভ্যতায় এই ভিত্তি হলো ‘সম্মতি’, আর আমাদের হলো নিকাহ। যৌনমিলন সম্ভব না হলে, নিকাহ (union) নিরর্থক। নিকাহের মাহরের দ্বারা স্ত্রীর যৌনসম্মতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অধিকাংশ আলিমের মতে (হাম্বলি ছাড়া বাকিদের মতে), মাহর নেবার পর যদি স্ত্রী সহবাসে অসম্মতি জানায় (শারঈ কারণ ছাড়া), তাহলে স্বামী মাহর ফেরত চাইতে পারবে। এবং স্ত্রী ভরণপোষণ পাবার অধিকার হারাবে।
সুতরাং ‘আইনত বৈধ যৌনমিলনে অনিচ্ছায়’ স্ত্রীর অবস্থান হবে ৪ নং, যা কখনোই ধর্ষণ (৫ নং) নয়। ৪ নং এবং ৫ নং কখনোই এক নয়, ইনসাফের দাবি এটা না।
চলবে ইনশাআল্লাহ
বই: ইসলামে দাস-দাসী ব্যবস্থা, মাকতাবাতুল আযহার, ডা. শামসুল আরেফীন
পরের পর্ব : বৈবাহিক ধর্ষণ ও বিবাহ দর্শন