<image>
পশ্চিমা বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে এনলাইটেনমেন্টের দর্শনের উপর, যেমনটা বিজ্ঞানী Rupert Sheldrake তাঁর Science Set Free 10 Paths To New Discovery বইয়ে বলেন:
...কিন্তু যে চিন্তাধারা আজকের বিজ্ঞানকে পরিচালিত করছে তা স্রেফ বিশ্বাস, যার শেকড় গেঁথে আছে ঊনবিংশ শতকের ভাবতত্ত্বের (এনলাইটেনমেন্ট) উপর।
Science Set Free 10 Paths To New Discovery
ঠিক সে কাজও করবে তেমনই। বর্তমান পশ্চিমা বিজ্ঞানের কাজই হল পশ্চিমা লিবারেল দর্শন ও নিত্যনতুন ভোগবাদী ধারণাগুলোকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করা। নারীবাদ, সমকামিতা— এগুলোর পায়ের নিচে মাটি এনে দেয়া। রিসার্চের নামে, জরিপের নামে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এগুলোকে দুনিয়ার সামনে অকাট্য হিসেবে উপস্থাপন করা। মোদ্দাকথা, বিজ্ঞান এখন পুঁজিবাদ-ভোগবাদ-বস্তুবাদী পশ্চিমা সভ্যতার একটা হাতিয়ার, একটা পুতুল। [১] MIT-এর প্রোফেসর পদার্থবিদ Evelyn Fox Keller বলেন:
মেইনস্ট্রীম বিজ্ঞানের ভাষা হচ্ছে আধুনিক ইউরোপীয় ও উত্তর আমেরিকান সমাজের প্রভাব বিস্তারের আদর্শ থেকে উৎসারিত। যা সৃষ্টিই হয়েছে তাদের মানসগঠনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চরিত্র থেকে।
Helen Longino, Science as Socioal Knowledge, p17
অর্থাৎ বিজ্ঞানের হাতিয়ারটি বর্তমানে পশ্চিমা সাদা সভ্যতা-সংস্কৃতির ভাষায়ই কথা বলে। অর্থাৎ এখানে আপনি একটা হোয়াইট সুপ্রিমেসির গন্ধও পাবেন। আজকের পপ-সায়েন্স লেখকরা এবং বিজ্ঞানবাদী গ্রুপগুলো মূলত এই White Supremacy থেকে জন্মানো কলোনিয়ালিজমেরই দালাল বই কিছু নয়। বিজ্ঞানের ছদ্মাবরণে তারা নব্য-উপনিবেশবাদের প্রোমোটার, যাতে ৩য় বিশ্ব চিরটাকাল উপনিবেশই থেকে যায়। অবনত মস্তকে আমরা ইউরোপ-আমেরিকার ঈশ্বরত্ব যাতে মেনে নিই, তাদের আদর্শকে তাদের চিন্তাকে 'আধুনিকতা ধর্ম' হিসেবে মেনে নিই, সেটাই এই লিবারেল মিশনারী ও বিজ্ঞান-মিশনারীদের কাজ। জেনে কিংবা না জেনে তারা ১ম বিশ্বের উপনিবেশবাদী এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করছে। উপনিবেশকে উপনিবেশ করে রাখার জন্য নেটিভদের আইডিওলজি খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার হচ্ছে বিজ্ঞানের মোড়ক। আর নেটিভরা ভাবছে, বিজ্ঞান তো ধ্রুবক-সদাসত্য, অতএব পশ্চিমা মূল্যবোধগুলোও সদাসত্য, প্রশ্নাতীত। অথচ পশ্চিমের এই বিজ্ঞান অবজেক্টিভ না, অপ্রভাবিত না।
মার্কিন বিজ্ঞান-দার্শনিক Helen Longino তাঁর Science as Socioal Knowledge গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন, বিজ্ঞান কীভাবে প্রভাবিত হয়। তাঁর যুক্তি হল, বিজ্ঞানের 'ভিতরের মূল্যবোধ' প্রভাবিত হয় 'বাইরের মূল্যবোধ' দ্বারা। একটু খুলে বলি। বিজ্ঞানের ভিতরের কিছু স্ট্যান্ডার্ড আছে, যেমন: প্রকৃতিবিজ্ঞানের কাজ যদি হয় প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা, তাহলে কোন ব্যাখ্যাকে 'ভালো ব্যাখ্যা' বলা হবে। কথার কথা, Truth-accuracy-simplicity-predictability-breadth— এই শর্তগুলো পুরা হলে সেটা ‘গুড সায়েন্স’। এটাকে তিনি বলছেন বিজ্ঞানের ভিতরগত গাঠনিক মূল্যবোধ (constitutive values)। কিন্তু এই শর্তগুলো পুরা হয়েছে বলা হবে কিনা, সেটা আবার নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক মূল্যবোধের (contextual values) উপর। পশ্চিমের কাছে যেটা Truth, যেটা এক্যুরেট, যেটা ভালো ব্যাখ্যা, সেটাই গুড সায়েন্স। অর্থাৎ ভিতরের মাপকাঠিগুলো প্রভাবিত হচ্ছে বাইরের (পশ্চিমা সমাজের) বুঝ দ্বারা। হেলেন বলেন:
বৈজ্ঞানিক গবেষণার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, ডেটা থেকে কী বুঝবো, আর কী বুঝবো না তা নির্দিষ্ট থাকে। এগুলো মিলে যাবার উপর নির্ভর করে গবেষণাটির সফলতা এবং সফলতার মাপার শর্ত। এবং মানব কর্মকাণ্ড হিসেবে বিজ্ঞানও সামাজিকভাবেও নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠে, যা ঠিক করে দেয় গবেষণাটির লক্ষ্য ও সাফল্যের শর্ত। আর শেষমেশ, ইতিহাস-সমাজ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তৈরি হয় বিজ্ঞান। আর এদের সাথে বিজ্ঞানের লেনদেন সবসময়ই চলমান। [২]
অর্থাৎ বিজ্ঞান চাইলেও নৈর্ব্যক্তিক (objective) হতে পারে না, নিরপেক্ষ (value-free) হতে পারে না। এই সীমাবদ্ধতাটুকু মেনে নিলে বিজ্ঞানের উপরই স্ট্রেস কমে। এ নিয়ে পশ্চিমা একাডেমিকদের বিতর্ক ৩ ধারায় চলমান—
- একদল বলেন, ঠিক আছে বিজ্ঞান প্রভাবিত হয়, তবে যতখানি প্রভাবিত হবে, সেটা ততই ‘পচা-বিজ্ঞান’।
- আরেকদল বলছেন, বিজ্ঞানের পদ্ধতিটাই সামাজিক, সুতরাং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত ও সমাজের স্বার্থ দ্বারা তাড়িত।
- তৃতীয় দল বলেন, বিজ্ঞান মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত, ফলে অনিবার্যভাবে তা বিজ্ঞানী ও তাদের সমাজের প্রতিফলন। [৩]
পশ্চিমা গবেষকেরা বিজ্ঞানের থিওরি এবং দর্শনের এই পারস্পরিকতা নিয়ে কাজ করছেন। যেমন,
- ডারউইনিয়ান বিবর্তনতত্ত্ব এবং ১৯ শতকের পুঁজিবাদের মাঝে সম্পর্ক,
- ১৯ শতকের মগজ পরিমাপ (craniometry) এবং বর্ণবাদের দ্বারা উপনিবেশের জাস্টিফিকেশান।
- গবেষকগোষ্ঠী বা অর্থদাতাগোষ্ঠীর স্বার্থ এবং রিসার্চের অন্তর্নিহিত সম্পর্ক
- পলিসি তৈরিতে রিসার্চের ভূমিকা, ইত্যাদি। বিশেষত, সরকার ও কর্পোরেট অর্থদাতা গোষ্ঠীর স্বার্থ দ্বারা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়া তো খুবই স্বাভাবিক। [৪]
বিশেষ করে আমেরিকার psychology academia-র scientific dishonesty তো পুরো একাডেমিয়াতে মশহুর। হস্তমৈথুন, সমকাম, নারীবাদের অধিকাংশ গবেষণা সাইকোলজিস্টরা করেছে। সাইকোলজিস্টদের এসব ‘এসি রুমে বসা’ থিওরির সাথে ডাক্তারদের (যারা ফিল্ডে কাজ করে) বহু বিষয়ে ইখতেলাফ রয়েছে। অনেক আর্টিকেল পাবেন যেখানে পরস্পর পরস্পরকে ধুয়ে দিচ্ছে। আমেরিকার সাইকিয়াট্রিস্টদের করা DSM-5 ব্রিটিশ সাইকিয়াট্রিস্টরা বয়কট করেছিল এই অভিযোগে যে, তারা কর্পোরেট ফার্মা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে 'অসুখ নয়'এমন জিনিসকে অসুখ প্রমাণ করেছে, যাতে ওষুধের বিক্রি বাড়ে। [৫] চিন্তা করেন?
শুধু কি তাই। গবেষণায় প্রাপ্ত ডেটা থেকে কী সিদ্ধান্তে আসা হবে, সে ব্যাপারেও বিজ্ঞান পুরোপুরি স্বাধীন না। বিখ্যাত আধুনিক দার্শনিক W.O. Quine তাঁর বিখ্যাত ‘two dogmas of empiricism’-এ বলেন:
... observations themselves are partly shaped by theory [theory-laden].
অর্থাৎ, প্রাপ্ত ডেটা যা-ই আসুক, তাকে টেনেটুনে প্রচলিত ডোমিনেন্ট থিওরির অধীনে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা অবচেতনেই কাজ করে বিজ্ঞানীদের। সবাই তো আর পাগল না, ক্যারিয়ার হারানোর চেয়ে স্রোতে গা ভাসানোই সেইফ।
তাহলে বুঝলেন তো, যে সর্ষের ভিতরে-বাইরে খালি ভূত আর ভূত, সেটা দিয়ে ভূত তাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। পশ্চিমা বিজ্ঞান পশ্চিমা আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, সুতরাং পশ্চিমা বিজ্ঞানকে প্রতিটি জাতি তার নিজের আদর্শ দ্বারা যাচাই না করে গ্রহণ করাটাই বোকামি ও বদ্ধমনের পরিচয়। পশ্চিমা বিজ্ঞানকে পরম কষ্টিপাথর ধরে নেবার সুযোগ নেই।
রেফারেন্স:
[১] Science, Capitalism, and the Rise of the “Knowledge Worker”: The Changing Structure of Knowledge Production in the United States, Author(s): Daniel Lee Kleinman and Steven P. Vallas. Source: Theory and Society, Vol. 30, No. 4 (Aug., 2001), pp. 451-492
[২] Helen Longino, Science as Socioal Knowledge, p17
[৩] ibid, p7
[৪] ibid, p3
[৫] Watts G. Critics attack DSM-5 for overmedicalising normal human behaviour BMJ 2012; 344 :e1020
বই: কাঠগড়া | সন্দীপন প্রকাশনী
<image>